ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) সম্প্রতি শিক্ষক সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে—সারপ্লাস বা অতিরিক্ত হিসেবে চিহ্নিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আবারও তাঁদের পুরনো স্কুলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ‘সারপ্লাস ট্রান্সফার’ নিয়ে এই নতুন পদক্ষেপ রাজ্যের স্কুল শিক্ষার কাঠামোতে এক নতুন দিশা আনবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—
-
সারপ্লাস ট্রান্সফার ঠিক কী
-
SSC-র নতুন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট
-
শিক্ষকদের সমস্যা ও তাদের প্রত্যাবর্তনের কারণ
-
প্রশাসনিক ব্যাখ্যা ও অভিভাবক-ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া
-
ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রভাব
সারপ্লাস ট্রান্সফার কী?
‘সারপ্লাস ট্রান্সফার’ বলতে বোঝানো হয়, কোনও নির্দিষ্ট স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় বা শিক্ষক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, একজন শিক্ষককে অন্য স্কুলে স্থানান্তরিত করা। এক্ষেত্রে তিনি সেই স্কুলের “অতিরিক্ত” বা “সারপ্লাস” হয়ে যান।
উদাহরণস্বরূপ:
একটি হাই স্কুলে আগে ১০০০ ছাত্র ছিল এবং সেই অনুযায়ী ২০ জন শিক্ষক ছিলেন। এখন সেই স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০, অথচ শিক্ষক এখনও ২০ জন। তখন SSC সেই স্কুল থেকে কয়েকজন শিক্ষককে ‘সারপ্লাস’ ঘোষণা করে অন্য স্কুলে পাঠায় যেখানে শিক্ষক প্রয়োজন।
SSC-র নতুন ঘোষণা: শিক্ষকদের পুরনো স্কুলে ফেরার সুযোগ
২০২৫ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, যে সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা গত কয়েক বছর ধরে সারপ্লাস হিসেবে অন্যত্র বদলি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছায় নিজের পুরনো স্কুলে ফেরার আবেদন করেছেন।
ঘোষণার মূল পয়েন্টগুলি:
-
স্বেচ্ছামূলক আবেদন গ্রহণ শুরু হয়েছে।
-
শিক্ষক চাইলে নিজে আগের স্কুলে ফিরে যেতে পারবেন, যদি সেখানে আসন খালি থাকে।
-
আবেদন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইন।
-
জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকদের যাচাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
ঘটনার পেছনের বাস্তবতা ও শিক্ষক-অভিজ্ঞতা
সারপ্লাস ট্রান্সফারে অনেক শিক্ষক বাধ্য হয়ে নিজের এলাকা ছেড়ে দূরের জেলায় চাকরি করতে যান। এতে তাঁদের পারিবারিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
বেশিরভাগ শিক্ষকই অভিযোগ করেছেন—
-
জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে
-
দূরত্বের কারণে ক্লান্তি ও স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে
-
অপরিচিত পরিবেশে পড়ানোর অসুবিধা হয়েছে
-
ছাত্রদের সঙ্গে মানসিক বন্ধন গড়ে তুলতে সময় লেগেছে
এই পরিস্থিতি তাঁদের মনোবল ভেঙে দেয়। তাই SSC-র এই নতুন সিদ্ধান্ত অনেক শিক্ষকের কাছে আশার আলো।
কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল?
১. শিক্ষকদের চাপ ও মানসিক অবসাদ
SSC এবং শিক্ষামন্ত্রকের কাছে প্রচুর অভিযোগ寄寄 হয়েছিল। বহু শিক্ষক নিজের পরিবার, সন্তানদের শিক্ষাজীবন ও ব্যক্তিগত সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন।
২. ফাঁকা পড়ে থাকা স্কুলগুলোর পুনরুজ্জীবন
অনেক পুরনো স্কুলে শিক্ষক না থাকায় পঠনপাঠনে সমস্যা হচ্ছিল। এবার সেই স্কুলে আগের শিক্ষক ফিরে এলে শিক্ষা-মান উন্নত হবে।
৩. ছাত্রদের উন্নতির কথা বিবেচনা
ছাত্ররা পুরনো শিক্ষকের প্রতি আবেগী হয়, শিক্ষকের প্রত্যাবর্তনে পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ে। একে ‘শিক্ষাগত সম্পর্ক পুনঃস্থাপন’ বলা যেতে পারে।
আবেদন প্রক্রিয়া ও সময়সীমা
SSC জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে অনলাইনে আবেদন জমা নেওয়া হবে।
মূল ধাপগুলি:
-
SSC-র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লগইন
-
প্রোফাইল যাচাই
-
আগের স্কুলের নাম ও পোস্ট উল্লেখ করে ‘রিটার্ন রিকোয়েস্ট’ ফর্ম পূরণ
-
সংশ্লিষ্ট জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক যাচাই করে ফাইনাল অনুমোদন দেবেন
বিরোধিতা ও বিতর্কও রয়েছে
যদিও সিদ্ধান্তটি অনেকের কাছে ইতিবাচক, তবুও কিছু মহলের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে—
১. নতুন স্কুলে শিক্ষক বদল মানে নতুন শূন্যপদ
অনেক স্কুল যেখানে এই শিক্ষকরা স্থানান্তরিত হয়ে এসেছিলেন, তারা এখন আবার শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়বে।
২. ছাত্রদের অস্থিরতা
নতুন শিক্ষক বিদায় নিলে ছাত্রদের মানসিক পরিবর্তন আসে, পড়াশোনায় প্রভাব পড়ে।
৩. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আশঙ্কা
কিছু মহল আশঙ্কা করছেন—এই ফেরানোর প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতি হতে পারে।
শিক্ষকদের অভিমত
বিভিন্ন জেলার শিক্ষকরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন—
“আমি তিন বছর আগে আমার নিজের বাড়ির ৩০ কিমি দূরের একটি স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। প্রতিদিন যাতায়াত করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন নিজের স্কুলে ফিরতে পারলে নতুন করে বাঁচার আশা করছি।”
— একজন ভূগোল শিক্ষক, নদিয়া জেলা থেকে
“নিজের ছাত্রদের কাছে ফেরার সুযোগ পেয়ে আমি খুব আনন্দিত। আমরা শুধু শিক্ষক নই, অভিভাবকও। ফেরার এ সুযোগ আমাদের গর্বিত করছে।”
— একজন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, মুর্শিদাবাদ জেলা
অভিভাবক ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া
অভিভাবকদের অনেকেই জানিয়েছেন যে আগের শিক্ষকেরা ফিরে এলে বাচ্চাদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি উৎসাহ বাড়বে।
“আমার ছেলের আগের শিক্ষক খুব ভালোভাবে বোঝাতেন। তিনি চলে যাওয়ায় মন ভেঙে গিয়েছিল। এখন শুনছি তিনি ফিরবেন—আমরা খুব খুশি।”
— একজন অভিভাবক, বর্ধমান থেকে
ছাত্ররাও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে নিজেদের আবেগ জানাচ্ছে।
SSC-র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
SSC জানিয়েছে, ‘সারপ্লাস ট্রান্সফার’ ও ‘রিভার্স ট্রান্সফার’ একযোগে চালিয়ে শিক্ষক পরিকাঠামোকে আরও কার্যকর করে তোলা হবে।
তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে:
-
ট্র্যাকিং সিস্টেম: শিক্ষক কোথায় গেছেন ও কখন ফিরবেন তা অনলাইনে ট্র্যাক করা যাবে।
-
AI ভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট: কোন স্কুলে শিক্ষক প্রয়োজন তা AI বিশ্লেষণ করে জানাবে।
-
ছাত্র-শিক্ষক রেশিও বজায় রাখা
উপসংহার: এটি কি স্থায়ী সমাধান?
SSC-র এই পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—
এই ব্যবস্থা কি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে?
এটা কি শুধুই চাপ কমানোর সাময়িক উপায়?
সমাধান স্থায়ী করতে হলে SSC ও শিক্ষামন্ত্রককে:
-
স্থানান্তর নীতিকে আরো স্বচ্ছ করতে হবে
-
ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের ফর্মুলা পরিবর্তন করতে হবে
-
প্রযুক্তি-ভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণের ওপর জোর দিতে হবে
শেষ কথা
শিক্ষকরা শুধু একটি চাকরি করেন না—তাঁরা ভবিষ্যৎ গড়েন। তাঁদের মানসিক শান্তি, পরিচিত পরিবেশে কাজের সুযোগ শিক্ষার মান বাড়াতে সহায়ক হয়। SSC-র এই পদক্ষেপ হয়তো একটি ছোট শুরু, কিন্তু এর প্রভাব হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষা আরও গঠনতান্ত্রিক ও মানবিক হয়ে উঠবে বলেই আশা করা যায়।
ছবি যোগ করতে চাইলে:
-
"শিক্ষক স্কুলে প্রবেশ করছেন" এই দৃশ্যের একটি ছবি
-
SSC অফিসের ছবি
-
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়াশোনার মুহূর্ত
আপনার মতামত জানান:
আপনার এলাকায় এমন কোনও শিক্ষক রয়েছেন যিনি ফিরে এসেছেন পুরনো স্কুলে? তাদের গল্প জানাতে পারেন মন্তব্যে।