**অমিতাভ বচ্চনের জীবনী: বলিউডের মহানায়ক**
অমিতাভ বচ্চন—এই নামটি শুনলেই মনে পড়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অনন্য ব্যক্তিত্বের কথা, যিনি শুধু একজন অভিনেতাই নন, একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে (বর্তমান প্রযাগরাজ) জন্মগ্রহণ করেন অমিতাভ। তার বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন ছিলেন বিখ্যাত হিন্দি কবি, এবং মা তেজি বচ্চন একজন সমাজকর্মী।
অমিতাভের শৈশব কেটেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিবেশে। তার বাবা তাকে কবিতা ও শিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। স্কুলজীবন শেষ করে তিনি দিল্লির কিরোরীমল কলেজে পড়াশোনা করেন এবং পরে কলকাতার বিখ্যাত ফিল্ম ইন্সটিটিউটে যোগ দেন।
**মুম্বাইয়ে আসা ও সংগ্রামের দিনগুলি**
অমিতাভ বচ্চন প্রথমে কলকাতায় একটি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতেন, কিন্তু অভিনয়ের টান তাকে মুম্বাইয়ে নিয়ে আসে। প্রথমদিকে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তার উচ্চ কণ্ঠস্বর ও লম্বা চেহারা নিয়ে অনেক প্রযোজক তাকে চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত মনে করেননি। কিন্তু অমিতাভ হাল ছাড়েননি।
**বলিউডে প্রবেশ ও প্রথম সাফল্য**
১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় অমিতাভের প্রথম চলচ্চিত্র **"সাত হিন্দুস্তানি"**, যেখানে তিনি সাত বিপ্লবীর একজন হিসেবে অভিনয় করেন। যদিও সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি, তবুও এটি অমিতাভকে বলিউডে প্রবেশের সুযোগ দেয়।
এরপর ১৯৭১ সালে **"আনন্দ"** সিনেমায় ডাক্তার ভাস্কর বর্মা চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের নজর কাড়েন। এই সিনেমায় রাজেশ খান্নার সঙ্গে তার কেমিস্ট্রি দর্শকদের মুগ্ধ করে।
**"জঞ্জীর" ও অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ইমেজ**
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় **"জঞ্জীর"**, যা অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ারে বিপ্লব ঘটায়। এই সিনেমায় তিনি ইন্সপেক্টর বিজয় খান্না চরিত্রে অভিনয় করেন, যা তাকে "অ্যাংরি ইয়াং ম্যান" (রাগী যুবক) খ্যাতি এনে দেয়। এই চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।
**সালিম-জাভেদ জুটি ও মহানায়কের উত্থান**
১৯৭০-৮০-এর দশকে অমিতাভ বচ্চন, লেখক জুটি সালিম-জাভেদ (সালিম খান ও জাভেদ আখতার) এবং পরিচালক প্রকাশ মেহরার সঙ্গে কাজ করে একের পর এক হিট সিনেমা দেন।
- **"দিওয়ার" (1975):** এই সিনেমায় অমিতাভ "বিজয়" চরিত্রে অভিনয় করেন, যার ডায়লোগ **"মেরে পাস মা হ্যায়"** আজও কাল্ট স্ট্যাটাস ধারণ করে।
- **"শোলে" (1975):** অমিতাভ "জয়" চরিত্রে অভিনয় করেন, যা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত।
- **"ডন" (1978):** ডন চরিত্রে তার অভিনয় দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
**ব্যক্তিগত জীবন ও বিপর্যয়**
১৯৮২ সালে **"কুলী"** সিনেমার শুটিংয়ের সময় অমিতাভ গুরুতর আহত হন এবং প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান। এই সময় পুরো দেশ তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করে। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আবার চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসেন।
১৯৭৩ সালে তিনি বিখ্যাত অভিনেত্রী জয়া ভাদুড়ীকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান—শ্বেতা ও অভিষেক বচ্চন। অভিষেকও পরে বলিউডের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হন।
**৯০-এর দশকে পুনরুত্থান**
১৯৯০-এর দশকে অমিতাভের ক্যারিয়ার কিছুটা মন্দা দেখায়, কিন্তু ২০০০ সালে **"কহো না... প্যার হ্যায়"** সিনেমার মাধ্যমে তিনি পুনরায় দর্শকদের হৃদয় জয় করেন। এরপর তিনি টেলিভিশন শো **"কৌন বনেগা ক্রোড়পতি" (KBC)**-এর উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
**২১শ শতকে অমিতাভ: আজও অপরাজেয়**
বয়স তাকে থামাতে পারেনি। ২০০০-এর পরেও তিনি একের পর এক সফল সিনেমা দিয়েছেন:
- **"বাগবান" (2003)** – একজন অবহেলিত বাবার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয়।
- **"পা" (2009)** – প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার পান।
- **"পিকু" (2015)** – একজন ডায়াবেটিক রোগীর ভূমিকায় তার অভিনয় প্রশংসিত হয়।
**পুরস্কার ও সম্মাননা**
অমিতাভ বচ্চন অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন:
- **পদ্মশ্রী (1984), পদ্মভূষণ (2001), পদ্মবিভূষণ (2015)** – ভারত সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান।
- **ডি.লিট.** – বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
- **জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার** – "অগ্নিপথ" (1990) ও "পা" (2009)-এর জন্য।
**সামাজিক কাজ**
অমিতাভ বচ্চন শুধু একজন অভিনেতাই নন, একজন সমাজসেবীও। তিনি **পলিও নির্মূল** অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন এবং বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন।
**উপসংহার**
অমিতাভ বচ্চন শুধু একজন সুপারস্টার নন, তিনি একটি অনুপ্রেরণা। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ভারতীয় সিনেমায় রাজত্ব করছেন এবং আজও তিনি সক্রিয়। তার জীবনী শেখায়—**"কখনও হাল ছাড়ো না, সংগ্রাম করো এবং সাফল্য নিশ্চিত।"**