ভূমিকা
বিমানে ওঠা মানেই যেন এক নতুন যাত্রার সূচনা। আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে বিমানযাত্রা যেমন আরামদায়ক, তেমনই দ্রুতগতির। কিন্তু আকাশে ভেসে থাকা প্রতিটি বিমানের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে শত সতর্কতা, নিয়ন্ত্রণ, এবং সম্ভাব্য বিপদের মোকাবিলার প্রস্তুতি। তারই অংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ— “Mayday” বা বাংলায় বলা যায়, ‘মেডে কল’। বিমানে বিপদের মুহূর্তে যখন পাইলট এই শব্দটি রেডিওতে উচ্চারণ করেন, তখন বুঝতে হয়— সবকিছু স্বাভাবিক নয়।
এই ‘মেডে কল’ কখন করা হয়? কেন একবার নয়, তিনবার বলা হয় “Mayday! Mayday! Mayday!”? এই সংকেতের গুরুত্ব কী? আজকের ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব বিমান দুর্ঘটনা ও “মেডে কল” সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক নিয়ে।
মেডে কল কী?
‘Mayday’ শব্দটি শুনলে অনেকেই ভাবতে পারেন এটি ইংরেজি। বাস্তবে, এটি এসেছে ফরাসি শব্দ "m’aider" থেকে, যার অর্থ "help me" বা "আমাকে সাহায্য করুন"।
১৯২০ সালের দিকে ব্রিটিশ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এই শব্দটিকে জরুরি সংকেত হিসেবে গ্রহণ করে, যেহেতু এটি সহজে শোনা ও উচ্চারণ করা যায়, এবং যেকোনো ভাষার পাইলটও তা বুঝতে পারেন।
তিনবার কেন বলা হয় "Mayday"?
‘Mayday’ শব্দটি তিনবার পরপর বলা হয়, কারণ—
-
সংকেতটি স্পষ্টভাবে শোনা যায়,
-
রেডিও সিগন্যাল বিভ্রান্ত হলে পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায়,
-
অনুরূপ শব্দ বা রুটিন কমিউনিকেশনের সঙ্গে যেন মিশে না যায়।
“Mayday Mayday Mayday” বলার অর্থ হলো— জরুরি অবস্থা, প্রাণহানির আশঙ্কা, এবং অবিলম্বে সাহায্যের প্রয়োজন।
কোন পরিস্থিতিতে মেডে কল করা হয়?
বিমান চলাকালীন বিভিন্ন ধরণের সংকটে পাইলট মেডে কল ব্যবহার করেন। যেমন—
-
ইঞ্জিন ব্যর্থতা (Engine Failure)
-
অগ্নিকাণ্ড (Fire in cockpit/engine/cabin)
-
হঠাৎ কেবিনের প্রেসার কমে যাওয়া (Cabin Depressurization)
-
নেভিগেশন সিস্টেম বিকল হওয়া (Navigation Failure)
-
মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি
-
জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়া (Fuel Emergency)
-
বিমান ছিনতাই বা নিরাপত্তা হুমকি (Hijack)
মেডে কল করার পদ্ধতি কী?
বিমানের রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পাইলট নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে এই সংকেত পাঠান। সাধারণত:
-
ফ্রিকোয়েন্সি: 121.5 MHz (International distress frequency)
-
রেডিও মেসেজ:
“Mayday, Mayday, Mayday
This is [Aircraft call sign]
We have [nature of emergency]
We are at [altitude, location]
Requesting immediate assistance.”
উদাহরণস্বরূপ:
“Mayday Mayday Mayday, this is Delta 123, engine fire in right engine, altitude 9000 feet, near Kolkata, requesting emergency landing.”
মেডে কল এবং পাইলটদের প্রশিক্ষণ
বিপদের সময় ঘাবড়ে যাওয়া নয়— এই প্রশিক্ষণই পাইলটদের সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়। ‘Mayday’ কল দেয়ার সময় পাইলটরা পরস্পরের দায়িত্ব ভাগ করে নেন। একজন রেডিও যোগাযোগ রক্ষা করেন, আরেকজন বিমান নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দেন।
সিমুলেটর প্রশিক্ষণে পাইলটরা শিখে থাকেন কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মেডে কল করতে হয়, কোথায় জরুরি অবতরণ করতে হয়, এবং যাত্রীদের নিরাপদ রাখার উপায়।
মেডে কল পেয়ে কী করে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (ATC)?
১. ATC সঙ্গে সঙ্গে বিমানটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
২. আকাশপথ খালি করে ফেলে।
৩. কাছাকাছি কোনো রানওয়ে দ্রুত প্রস্তুত রাখা হয়।
৪. প্রয়োজনে ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়।
৫. রেডিওতে ধারাবাহিক যোগাযোগ রাখা হয়।
এছাড়া যদি বিমান রাডার থেকে হারিয়ে যায়, তখন সার্চ অ্যান্ড রেস্কিউ অপারেশন শুরু করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি।
মেডে কল বনাম পান প্যান (Pan-Pan) কল
অনেকে ‘Mayday’ এবং ‘Pan-Pan’ শব্দদুটিকে এক মনে করেন। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
বিষয় | Mayday | Pan-Pan |
---|---|---|
অর্থ | জরুরি, জীবনহানির আশঙ্কা | গুরুত্বপূর্ণ, তবে তেমন গুরুতর নয় |
প্রাধান্য | সর্বোচ্চ | মাঝারি |
ব্যবহার | ইঞ্জিন ফেইল, আগুন, ছিনতাই | রেডিও সমস্যা, যাত্রী অসুস্থতা |
বাস্তব কিছু ঘটনার উদাহরণ
১. US Airways Flight 1549 – "Miracle on the Hudson" (২০০৯)
পাখির আঘাতে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পাইলট সুলি ‘Mayday’ কল দেন এবং হাডসন নদীতে নিরাপদে বিমান নামান। ১৫৫ জন যাত্রীর প্রাণ বেঁচে যায়।
২. Air France Flight 447 (২০০৯)
আটলান্টিক মহাসাগরে উড়ন্ত অবস্থায় বিমানটি রাডার থেকে হারিয়ে যায়। মেডে কল দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ব্ল্যাকবক্স থেকে জানা যায় সমস্যার সূত্রপাত।
৩. SpiceJet SG 945 (২০২2)
পাখির আঘাতের পর পাইলট মেডে কল দেন এবং অবিলম্বে জরুরি অবতরণ করেন। যাত্রীদের কারও ক্ষতি হয়নি।
বিমানে বসে যাত্রী কীভাবে বুঝবেন "Mayday" সংকেত দেওয়া হয়েছে?
সাধারণ যাত্রীরা সরাসরি বুঝতে পারেন না। তবে কিছু লক্ষণ থাকে:
-
বিমান হঠাৎ উচ্চতা কমায়
-
কেবিন ক্রু অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যায়
-
ককপিটে আলো জ্বলে বা অডিও সংকেত আসে
-
নিরাপত্তা নির্দেশিকায় ঘোষণা শোনা যেতে পারে: “We are making an emergency landing.”
বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি
বাংলাদেশের CAAB (Civil Aviation Authority of Bangladesh) এবং ভারতের DGCA (Directorate General of Civil Aviation) আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে মেডে কল এবং জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করে।
উভয় দেশে বিমাবন্দরে রয়েছে:
-
ট্রেইন্ড এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার
-
মেডিকেল ইউনিট
-
ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ টিম
প্রযুক্তির উন্নয়নে মেডে সংকেতের আধুনিকীকরণ
বর্তমানে শুধু ভয়েস কমিউনিকেশন নয়, বিমানে রয়েছে:
-
ADS-B (Automatic Dependent Surveillance – Broadcast)
-
ACARS (Aircraft Communications Addressing and Reporting System)
এই সিস্টেমগুলো ‘মেডে’ তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠাতে পারে, যা সময় বাঁচায়।
‘মেডে’ কল মানে কি বিমানের অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনা?
না। অনেক সময় ‘Mayday’ কল দেওয়া হলেও পাইলট দক্ষতার সঙ্গে বিমান নিয়ন্ত্রণে আনেন। এটি বিপদের সংকেত, কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতি নয়। পাইলটের প্রশিক্ষণ, ATC-এর সহযোগিতা এবং যাত্রীদের শান্ত থাকা – এই তিনে অনেক দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব হয়।
উপসংহার
‘Mayday Mayday Mayday’— এই শব্দ তিনটি যেন একদিকে বিপদের আশঙ্কা, অন্যদিকে বাঁচার আকুতি। আধুনিক বিমান চলাচলের জগতে এই সংকেত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর পেছনের দায়িত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়াও জটিল।
আমরা যারা যাত্রী, আমাদের উচিত—
-
বিমানে ওঠার আগে সুরক্ষা নির্দেশিকা মনোযোগ দিয়ে শোনা,
-
বিপদের সময় আতঙ্ক না ছড়ানো,
-
কেবিন ক্রুদের নির্দেশ মানা।
কারণ, যাত্রী ও ক্রুদের একসাথে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করলেই জীবন বাঁচানো সম্ভব।