ভূমিকা
ভারতের কৃষিক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থেকেছে। কৃষকদের আয় অনিশ্চিত, ঋণের বোঝা ভারী, এবং কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার সমস্যায় দেশের বেশিরভাগ চাষী হতাশ। এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রীয় সরকার PM-Kisan Samman Nidhi Yojana চালু করেন—একটি প্রকল্প যা সরাসরি দেশের ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে অর্থ সহায়তা প্রদান করে। চলুন জেনে নিই এই যোজনাটি কী, কীভাবে কাজ করে, কারা এই সুবিধা পান এবং এর উপকারিতা কী কী।
১. PM-Kisan Yojana: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
PM-Kisan বা Pradhan Mantri Kisan Samman Nidhi Yojana হল কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্প, যার আওতায় দেশের প্রান্তিক কৃষকদের বছরে ₹৬,০০০ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
মূল বৈশিষ্ট্য:
-
ঘোষণা: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
-
কার্যকরী তারিখ: ১ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে
-
উদ্দেশ্য: কৃষকদের আর্থিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করা
-
সহায়তার পরিমাণ: প্রতি বছর ₹৬,০০০ (তিন কিস্তিতে)
-
অর্থপ্রদান পদ্ধতি: DBT (Direct Benefit Transfer)
২. যোজনার লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয়তা
২.১. কৃষকদের আর্থিক চ্যালেঞ্জ
ভারতের অধিকাংশ কৃষক ছোট বা প্রান্তিক চাষী। তাদের হাতে জমির পরিমাণ সীমিত এবং তারা প্রায়শই বীজ, সার ও কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে হিমশিম খান। ঋণগ্রস্ততা এবং আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলছিল।
২.২. লক্ষ্য
-
কৃষকদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করা
-
চাষের মৌসুমে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সহায়তা
-
কৃষকদের আত্মনির্ভর করে তোলা
৩. কারা এই সুবিধা পান? (যোগ্যতা)
PM-Kisan এর সুবিধা পেতে হলে নিচের শর্তগুলো মানতে হবে:
৩.১. উপযুক্ত প্রাপক
-
ভারতের নাগরিক হতে হবে
-
২ হেক্টর বা তার কম জমির মালিক হতে হবে (শুরুতে)
-
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও আধার কার্ড বাধ্যতামূলক
৩.২. অযোগ্য প্রার্থী
নিচের প্রকারের কৃষকরা এই সুবিধা পাবেন না:
-
সরকারী কর্মচারী
-
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে (পেনশন ₹১০,০০০ এর বেশি হলে)
-
আয়করদাতা
-
পেশাদার চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী
-
প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদ
৪. টাকা পাওয়ার নিয়ম ও প্রক্রিয়া
৪.১. কত টাকা, কখন
বছরে মোট ₹৬,০০০ তিন কিস্তিতে দেওয়া হয়:
-
প্রথম কিস্তি: এপ্রিল-জুলাই
-
দ্বিতীয় কিস্তি: আগস্ট-নভেম্বর
-
তৃতীয় কিস্তি: ডিসেম্বর-মার্চ
৪.২. আবেদন করার পদ্ধতি
অনলাইন মাধ্যমে:
-
PM-Kisan পোর্টাল ভিজিট করুন
-
“Farmer Corner” সেকশনে যান
-
“New Farmer Registration” বেছে নিন
-
আধার নম্বর, জমির তথ্য, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে ফর্ম পূরণ করুন
অফলাইন মাধ্যমে:
-
স্থানীয় CSC (Common Service Center)
-
ব্লক অফিস
-
কৃষি দপ্তর
৫. কীভাবে টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছায়?
সরকার DBT (Direct Benefit Transfer) প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা সরাসরি পাঠিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিতে:
-
কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকে না
-
দুর্নীতির সুযোগ কমে যায়
-
কৃষক সরাসরি উপকৃত হন
৬. eKYC বাধ্যতামূলক কেন?
সরকার eKYC বাধ্যতামূলক করেছে, যাতে প্রতারণা ও ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়। eKYC না করলে টাকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
eKYC করার উপায়:
-
OTP ভিত্তিক eKYC (মোবাইল নম্বর থাকতে হবে)
-
CSC-র মাধ্যমে বায়োমেট্রিক eKYC
৭. কেন এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ?
৭.১. সরাসরি আর্থিক সহায়তা
চাষিরা প্রতি মরসুমে বীজ, সার, জ্বালানি, মজুরি ইত্যাদির খরচ মেটাতে পারেন।
৭.২. দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা
এটি কৃষকদের উপর দারিদ্র্য ও ঋণের চাপ কমায়।
৭.৩. কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ে
এই টাকা দিয়ে ছোট কৃষকরা নিজস্ব কৃষিকাজে নতুন প্রযুক্তি বা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন।
৮. প্রকল্পের সাফল্য ও পরিসংখ্যান
-
প্রাপক সংখ্যা: ১১ কোটি+ কৃষক
-
মোট বিতরণকৃত অর্থ: ₹২.৮ লক্ষ কোটি (২০২৫ পর্যন্ত)
-
রাজ্যভিত্তিক সর্বোচ্চ প্রাপক: উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ
পশ্চিমবঙ্গ প্রসঙ্গ:
শুরুতে রাজ্য সরকার অংশ নেয়নি, পরে যোগ দেয় এবং লক্ষ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পের আওতায় আসেন।
৯. প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন (FAQ)
প্রশ্ন: আমি অন্যের জমিতে চাষ করি, কি আমি আবেদন করতে পারি?
উত্তর: না, জমির মালিক না হলে এই প্রকল্পে আবেদন করা যাবে না।
প্রশ্ন: টাকা ঢুকেছে কিনা কীভাবে জানব?
উত্তর: pmkisan.gov.in ওয়েবসাইটে “Beneficiary Status” সেকশন দেখে জানতে পারবেন।
প্রশ্ন: আবেদন করলে কত দিনে টাকা পাওয়া যায়?
উত্তর: যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সাধারণত ১৫-৩০ দিনের মধ্যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যায়।
১০. সমস্যাসমূহ ও সমাধান
১০.১. ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মিল না থাকা
অনেক সময় নামের ভুল বা IFSC কোড ভুল থাকায় টাকা ফেরত যায়। সঠিক তথ্য দিয়ে সংশোধন করতে হয়।
১০.২. জমির নথি না থাকা
জমির পাট্টা/নামজারি/খতিয়ান না থাকলে আবেদন বাতিল হয়।
১০.৩. আধার ভুল
আধার ও ব্যাঙ্কের মধ্যে নামের পার্থক্য থাকলে eKYC আটকে যায়।
১১. ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও সম্প্রসারণ
সরকার পরিকল্পনা করছে:
-
প্রাপকদের সাথে কৃষি উপদেশ, কৃষি বিমা, ও কৃষি শিক্ষার সংযুক্তিকরণ
-
একীভূত কৃষি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা
-
AI ভিত্তিক কৃষক প্রোফাইল তৈরি
১২. উপসংহার
PM-Kisan Yojana একটি যুগান্তকারী প্রকল্প যা ভারতের কোটি কোটি কৃষকের জীবনে আর্থিক স্বস্তি ও নিরাপত্তা এনেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, বরং কৃষককে মর্যাদা দেওয়া এবং দেশকে আত্মনির্ভর কৃষি অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আপনি যদি একজন কৃষক হন এবং এখনও এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত না করে থাকেন, তবে দেরি না করে এখনই আবেদন করুন।