**ভূমিকা**
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নাম, যাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস ও দর্শন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তাঁকে আমরা 'কবিগুরু' বলে সম্বোধন করি, কিন্তু কে বা কারা এই উপাধি দিয়েছিলেন? আশ্চর্যের বিষয়, ৯৯% বাঙালিই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানেন না! অনেকে মনে করেন এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, আবার কেউ কেউ ভাবেন যে এটি ব্রিটিশ সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া উপাধি। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন!
এই দীর্ঘ নিবন্ধে আমরা 'কবিগুরু' উপাধির ইতিহাস, এর পেছনের মানুষজন এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাংলার গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ নিয়ে আলোচনা করব।
**'কবিগুরু' উপাধির উৎস: কে দিয়েছিলেন?**
**১. সাধারণ ধারণা vs বাস্তবতা**
অনেকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি হিসাবে ব্রিটিশ সরকার, কোনো সাহিত্য সংস্থা বা বাঙালি সমাজ সম্মিলিতভাবে তাঁকে 'কবিগুরু' উপাধি দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, **এই উপাধিটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি সমালোচক ও সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত**।
**২. অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত: 'কবিগুরু' শব্দের প্রবর্তক**
অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত (১৮৫৬-১৯২৫) ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের গভীর অনুরাগী ছিলেন। **১৮৯৩ সালে 'সাহিত্য' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে 'কবিগুরু' বলে উল্লেখ করেন**।
**৩. কেন 'কবিগুরু'?**
- **গুরুর মর্যাদা**: রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন, তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পথপ্রদর্শক।
- **শিক্ষক হিসাবে তাঁর ভূমিকা**: শান্তিনিকেতনে তিনি শুধু কবিতা নয়, জীবনদর্শনও শিখিয়েছেন।
- **সাহিত্যে বিপ্লব**: তাঁর রচনায় বাংলা কবিতা ও গদ্যের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছিল।
**'কবিগুরু' উপাধি কীভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল?**
**১. বাঙালি সমাজের গ্রহণযোগ্যতা**
অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্তের পর এই শব্দটি ধীরে ধীরে বাঙালি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও দর্শনের গভীরতা মানুষকে এই উপাধি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
**২. রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি (১৯১৩) ও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি**
যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর **১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার** পান, তখন 'কবিগুরু' উপাধিটি আরও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভারত ও বিশ্বমঞ্চে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
**৩. গান্ধীজি, নেহরু ও অন্যান্য মহান ব্যক্তিত্বের ব্যবহার**
মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো নেতারাও রবীন্দ্রনাথকে 'কবিগুরু' বলে সম্বোধন করতেন, যা এই উপাধিকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে।
**'কবিগুরু' vs 'গুরুদেব': পার্থক্য কী?**
**১. 'কবিগুরু'**
- বিশেষভাবে তাঁর **কাব্যপ্রতিভা**-কে নির্দেশ করে।
- বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি।
**২. 'গুরুদেব'**
- শান্তিনিকেতনের ছাত্র ও ভক্তদের দেওয়া সম্মানসূচক সম্বোধন।
- এটি **আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাগুরু** হিসাবে তাঁর মর্যাদাকে নির্দেশ করে।
**রবীন্দ্রনাথ নিজে কী ভাবতেন এই উপাধি নিয়ে?**
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে খুবই বিনয়ী ছিলেন। তিনি কোনো উপাধি পছন্দ করতেন না, কিন্তু 'কবিগুরু' শব্দটিকে তিনি জনগণের ভালোবাসার প্রকাশ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর কিছু চিঠি ও রচনায় এই বিনয় ফুটে উঠেছে।
**৯৯% বাঙালি কেন এই তথ্য জানেন না?**
**১. ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া**
অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্তের নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তেমন আলোচিত হয় না, তাই তাঁর এই অবদানও অস্পষ্ট থেকে গেছে।
**২. উপাধিটির স্বতঃস্ফূর্ত গ্রহণ**
যেহেতু 'কবিগুরু' শব্দটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়েছিল, তাই এর উৎস নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম।
**৩. শিক্ষাপ্রণালীর ত্রুটি**
স্কুল-কলেজে রবীন্দ্রনাথের জীবনী পড়ানো হলেও 'কবিগুরু' উপাধির ইতিহাস খুব কমই উল্লেখ করা হয়।
**উপসংহার**
'কবিগুরু' শব্দটি কেবল একটি উপাধি নয়, এটি বাঙালির হৃদয়ের গভীর থেকে দেওয়া একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য। অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করলেও, এটি চিরস্থায়ী হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টিকর্মের জন্য। আজও আমরা যখন তাঁকে 'কবিগুরু' বলে সম্বোধন করি, তখন বাংলা সাহিত্যের সমস্ত গৌরব ও ঐতিহ্যকেই স্মরণ করি।
**আপনি কি জানতেন 'কবিগুরু' উপাধির এই ইতিহাস? নিচে কমেন্ট করে জানান!**