ডায়াবিটিসের লক্ষণসমূহ: বিস্তারিত বিশ্লেষণ




ডায়াবিটিস বা মধুমেহ একটি বিপাকীয় রোগ যা শরীরে ইনসুলিন হরমোনের অভাব বা অকার্যকারিতার কারণে সৃষ্টি হয়। এই রোগের লক্ষণগুলো প্রায়শই ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, তাই অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে তা বুঝতে পারেন না। নিম্নে আমরা ডায়াবিটিসের বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।


**ডায়াবিটিসের প্রধান লক্ষণসমূহ**


**১. অতিরিক্ত পিপাসা ও প্রস্রাব বৃদ্ধি (Polydipsia & Polyuria)**

- **প্রস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি:** রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে কিডনি অতিরিক্ত গ্লুকোজ বের করতে বেশি পরিশ্রম করে, ফলে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে (প্রতিদিন ৩ লিটার বা তার বেশি)।

- **তৃষ্ণার্ত বোধ:** অতিরিক্ত প্রস্রাবের কারণে শরীর ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়, ফলে অস্বাভাবিক পিপাসা লাগে।

- **রাতের বেলা প্রস্রাব:** অনেকেই রাতে বারবার প্রস্রাব করার জন্য জেগে ওঠেন (Nocturia)।


**২. অতিরিক্ত ক্ষুধা (Polyphagia)**

- **খাওয়া সত্ত্বেও ক্ষুধা:** শরীর কোষে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে না পারায় শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে মস্তিষ্ক ক্ষুধার সংকেত দিতে থাকে।

- **ওজন হ্রাস:** টাইপ-১ ডায়াবিটিসে ইনসুলিনের অভাবে শরীর শক্তি উৎপাদনের জন্য মাংসপেশি ও ফ্যাট ভাঙতে শুরু করে।


**৩. অবসাদ ও দুর্বলতা**

- **শক্তির অভাব:** গ্লুকোজ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল বোধ করে।

- **কাজে অনীহা:** সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে ওঠা বা ঘুম ঘুম ভাব।


 **৪. দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন**

- **ঝাপসা দেখা:** রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়লে চোখের লেন্স ফুলে যায়, ফলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়।

- **চোখ শুষ্ক হওয়া:** ডায়াবিটিক নিউরোপ্যাথির প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।


**৫. ক্ষত শুকাতে বিলম্ব**

- **রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস:** উচ্চ রক্ত শর্করা শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

- **ছোট কাটাছেঁড়া বা ফোঁড়া দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়া।**


 **৬. ত্বকের সমস্যা**

- **ত্বক শুষ্ক ও চুলকানি:** বিশেষ করে যৌনাঙ্গে চুলকানি বেশি দেখা যায়।

- **কালো দাগ (Acanthosis Nigricans):** ঘাড়, বগল বা কুঁচকিতে কালচে চামড়া হওয়া ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের লক্ষণ।


**৭. সংক্রমণের প্রবণতা**

- **বারবার মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI)**

- **যৌনাঙ্গে ছত্রাক সংক্রমণ (Candidiasis)**

- **মাড়ির রোগ ও দাঁতের সমস্যা**


 **টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবিটিসের লক্ষণের পার্থক্য**


লক্ষণ | টাইপ-১ ডায়াবিটিস | টাইপ-২ ডায়াবিটিস |


**শুরুর বয়স** | সাধারণত শিশু বা তরুণ বয়সে | সাধারণত ৪০ বছরের পর |

**লক্ষণ প্রকাশ** | হঠাৎ ও তীব্র (কয়েক সপ্তাহে) | ধীরে ধীরে (বছরেও নাও দেখা দিতে পারে) |

 **ওজন** | দ্রুত ওজন হ্রাস | ওজন বৃদ্ধি/স্থূলতা |

 **কিটোন বডি** | বেশি তৈরি হয় (DKA ঝুঁকি) | সাধারণত থাকে না 


 **গর্ভকালীন ডায়াবিটিসের লক্ষণ**

- **স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পিপাসা ও প্রস্রাব**

- **বমি বমি ভাব (সাধারণ গর্ভাবস্থার লক্ষণের সাথে মিলে যেতে পারে)**

- **যোনিপথে বারবার সংক্রমণ**


**কখন ডাক্তার দেখাবেন?**

- উপরের যেকোনো লক্ষণ একসাথে দেখা দিলে

- পরিবারে ডায়াবিটিসের ইতিহাস থাকলে

- ৪৫ বছরে   বয়সী ব্যক্তিদের নিয়মিত চেকআপ


 **পরীক্ষা-নিরীক্ষা**

- **Fasting Blood Sugar:** ১২৬ mg/dL এর বেশি

- **HbA1c:** ৬.৫% এর বেশি

- **OGTT:** ২০০ mg/dL এর বেশি


 **প্রতিকারের উপায়**

- **খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন:** কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার

- **নিয়মিত ব্যায়াম:** দিনে ৩০ মিনিট হাঁটা

- **ওজন নিয়ন্ত্রণ:** BMI ২৫ এর নিচে রাখার চেষ্টা


 **জটিলতা**

অবহেলা করলে ডায়াবিটিস থেকে হতে পারে:

- **হৃদরোগ**

- **কিডনি রোগ (নেফ্রোপ্যাথি)**

- **পায়ের আলসার (ডায়াবেটিক ফুট)**


ডায়াবিটিসের লক্ষণ শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। বছরে একবার রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত সকলেরই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন