মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি: নীরব ঘাতকের ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি

 


ভূমিকা

বর্তমান সভ্যতায় প্লাস্টিকের ব্যবহার যেমন জীবনকে সহজ করে তুলেছে, তেমনই এর অপব্যবহার মানবদেহে সৃষ্টি করছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং আলোচিত বিষের নাম—মাইক্রোপ্লাস্টিক। এটি এমন এক উপাদান, যা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক রোগের জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে—মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।


মাইক্রোপ্লাস্টিক কী?

মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো ৫ মিলিমিটারের কম ব্যাসের প্লাস্টিক কণা, যা মূলত দুইভাবে তৈরি হয়:

  1. প্রাইমারি মাইক্রোপ্লাস্টিক: সরাসরি ক্ষুদ্র আকারে উৎপাদিত যেমন ফেসওয়াশ, কসমেটিক্স বা টুথপেস্টে থাকা প্লাস্টিক বিডস।

  2. সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিক: বড় প্লাস্টিক সামগ্রী ভেঙে ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়, যেমন পানির বোতল, প্লাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদি।


মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে মানবদেহে প্রবেশ করে?

  • খাদ্যের মাধ্যমে: মাছ, সামুদ্রিক খাবার, ফল, শাকসবজি, এমনকি লবণেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।

  • পানির মাধ্যমে: বোতলজাত পানি, নলকূপ বা কলের পানিতে রয়েছে এই ক্ষুদ্র কণা।

  • বাতাসের মাধ্যমে: ধুলাবালির সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।

  • রূপচর্চার সামগ্রী: প্রতিদিন ব্যবহৃত স্ক্রাব, ফেসওয়াশে থাকা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা ত্বকের মাধ্যমে প্রবেশ করে।


মাইক্রোপ্লাস্টিক ও রক্তনালী: অদৃশ্য ঝুঁকি

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করে রক্তনালীতে জমা হতে থাকে। এই জমাকৃত কণা রক্তপ্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে, যার ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যেতে পারে, এবং দীর্ঘমেয়াদে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

  • ইতালির ক্যাম্পানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা: ১২১ জন স্ট্রোক রোগীর রক্তনালী বিশ্লেষণে ৫৮% রোগীর শরীরে পলিপ্রোপাইলিন ও পলিইথিলিন কণা পাওয়া গেছে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের নিউরোসায়েন্স রিসার্চ জার্নাল: মাইক্রোপ্লাস্টিক স্নায়ু কোষে প্রদাহ সৃষ্টি করে।


স্ট্রোক কী এবং কীভাবে ঘটে?

স্ট্রোক হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে সেই অংশ অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, এবং কোষ দ্রুত মারা যেতে শুরু করে।

স্ট্রোক প্রধানত দুই ধরনের:

  1. ইস্কেমিক স্ট্রোক: রক্তনালীর ব্লকেজের কারণে।

  2. হেমোরেজিক স্ট্রোক: রক্তনালীর ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তনালী ব্লক করার মাধ্যমে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।


মাইক্রোপ্লাস্টিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি

  • স্ট্রোক ছাড়াও আরও যেসব রোগ হতে পারে:

    • হৃদরোগ

    • উচ্চ রক্তচাপ

    • ক্যানসার

    • কিডনি ফেইলিউর

    • প্রজনন সমস্যাও বন্ধ্যাত্ব

    • অটিজম ও নিউরো-ডিজঅর্ডার

  • শিশুদের উপর প্রভাব:

    • গর্ভবতী নারীদের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক ভ্রূণের দেহেও প্রবেশ করতে পারে, যার ফলে শিশু বিকাশে বিঘ্ন ঘটে।


বিশ্বজুড়ে গবেষণা ও সতর্কবার্তা

  • WHO-এর রিপোর্ট: মাইক্রোপ্লাস্টিক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হলেও, এর পূর্ণাঙ্গ প্রভাব এখনো গবেষণাধীন।

  • Lancet Journal: রক্তনালী ও নিউরন-লিঙ্কযুক্ত অসুস্থতার জন্য মাইক্রোপ্লাস্টিক দায়ী হতে পারে।

  • UNEP রিপোর্ট: ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের তুলনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে।


কেন এখনই সচেতন হওয়া জরুরি?

  • বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জলাধারে ও খাদ্যচক্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে।

  • এটি সহজে শরীর থেকে বের হয় না।

  • দীর্ঘমেয়াদে মানুষের জেনেটিক কোড পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।


কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন?

  1. বোতলজাত পানি এড়িয়ে চলুন।

  2. প্লাস্টিক প্যাকেট বা পাত্রে গরম খাবার রাখবেন না।

  3. ফেসওয়াশ বা স্ক্রাব বেছে নিন যেগুলিতে 'microbeads free' লেখা থাকে।

  4. ঘরে পানি ফিল্টার ব্যবহার করুন।

  5. সাধ্য অনুযায়ী স্টিল, কাচ বা মাটির পাত্র ব্যবহার করুন।

  6. সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন।

  7. বাজার থেকে খাবার কিনে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।


সরকারি পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ করণীয়

  • প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।

  • রিসার্চ ফান্ডিং: মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষণায় আরও সরকারি সাহায্য।

  • সচেতনতা কর্মসূচি: স্কুল, কলেজ ও গ্রামে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে প্রচার।

  • পরিবেশবান্ধব বিকল্প: জুট, কাপড়, বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহারের উৎসাহ দেওয়া।


উপসংহার

মাইক্রোপ্লাস্টিক যেন এক নিরব ঘাতক। এটি প্রতিদিন আমাদের শরীরে ঢুকছে অথচ আমরা জানতেও পারছি না। বিশেষত এর স্ট্রোকের মতো প্রাণঘাতী রোগের সাথে সম্পর্ক আমাদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। এখনই আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে প্লাস্টিককে না বলা এবং প্রাকৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন