রাজীব গান্ধী হত্যা: পারিবারিক শাসনের অবসান ও বিজেপির উত্থান

 


ভূমিকা

১৯৯১ সালের ২১ মে রাতে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুম্বুদুরে এক প্রচারণা সভায় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু শুধু কংগ্রেস নয়, ভারতের রাজনীতিক পরিসরে বিশাল এক শূন্যতা সৃষ্টি করে। এই হত্যাকাণ্ড কংগ্রেসের দীর্ঘস্থায়ী ‘গান্ধী পরিবারকেন্দ্রিক’ শাসনের ভীত নড়িয়ে দেয়। একইসঙ্গে এটি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিকাশ ও উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।


রাজীব গান্ধীর রাজনৈতিক উত্থান ও নেতৃত্ব

রাজীব গান্ধী কখনোই রাজনীতিতে আসতে চায়নি। বড় ভাই সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু রাজনীতির মাঠে তাঁকে নামিয়ে আনে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন রাজীব। তাঁর সময়কার প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণমূলক সিদ্ধান্ত তাঁকে ‘আধুনিক ভারতের রূপকার’-এ পরিণত করে। তবে বোফর্স কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।


হত্যাকাণ্ডের পটভূমি ও এলটিটিইর ভূমিকা

রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে তামিল টাইগারস (LTTE) চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। ভারতের তামিল জনগোষ্ঠীর একাংশ এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে নেয়। এর ফলশ্রুতিতে এলটিটিই রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ধানু নামক এক মহিলা আত্মঘাতী বোমার সাহায্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।


রাজীব গান্ধীর মৃত্যু এবং কংগ্রেসের দুর্বলতা

রাজীবের মৃত্যুর পর কংগ্রেস হঠাৎ একটি শূন্যতায় পড়ে যায়। গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে দলটি নির্ভরশীল ছিল। সে সময় কংগ্রেস প্রধান হিসেবে কোন সুসংবদ্ধ নেতৃত্ব উঠে আসেনি। সোনিয়া গান্ধী প্রথমে রাজনীতিতে আসতে রাজি হননি। কংগ্রেস নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েন, এবং দলের ভিতরকার কোন্দল ক্রমশ বেড়ে যায়।


বিজেপির উত্থান: একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা

রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই শূন্যতার সুযোগ নেয় বিজেপি। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে রাম মন্দির আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে বিজেপি জনসমর্থন পেতে শুরু করে। ১৯৯६ সালে তারা প্রথমবারের মতো কেন্দ্রে সরকার গঠন করে, যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ১৯৯৮ সালে আবার ক্ষমতায় এসে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করে।


পারিবারিক রাজনীতির পতন ও আদর্শগত রাজনীতির উত্থান

গান্ধী পরিবার দীর্ঘদিন ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। রাজীবের মৃত্যুর পরপরই সেই পারিবারিক প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। বিজেপি একটি আদর্শভিত্তিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যারা হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার বানিয়ে জনমনে স্থান করে নেয়। কংগ্রেস যেখানে ব্যক্তি-নির্ভর, বিজেপি সেখানে দলীয় কাঠামো ও আদর্শে বিশ্বাস করে।


সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্ব ও নতুন অধ্যায়

দীর্ঘ অনিচ্ছার পর সোনিয়া গান্ধী রাজনীতিতে আসেন এবং কংগ্রেস পুনরায় একত্রিত হয়। ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার গঠন করে। যদিও গান্ধী পরিবারের ভাবমূর্তি কিছুটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, তবুও তার প্রভাব রাজীবের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।


বিজেপির আধিপত্য: মোদী যুগের সূচনা

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসে, এবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। এটি এক নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করে। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু সরে যায় গান্ধী পরিবার থেকে। ‘নতুন ভারত’-এর ধারণা ও আধুনিক উন্নয়নমূলক ভাবনা বিজেপিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে।


রাজীব গান্ধী হত্যার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া

এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে টিডি টিওয়ারি কমিশন এবং পরবর্তীতে জাস্টিস ভর্মা কমিশন। বহু এলটিটিই সদস্যকে গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের অনেক রহস্য আজও অনাবৃত রয়েছে, তবুও এটি ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় একটি শিক্ষা হয়ে থাকে।


সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যমে প্রভাব

রাজীব গান্ধীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেক চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি ও বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘Madras Cafe’ নামক বলিউড সিনেমা এলটিটিই ও হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এসব মাধ্যমে তাঁর জীবন ও মৃত্যু জনমানসে গভীর প্রভাব ফেলে।


উপসংহার

রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ড কেবল একজন নেতার মৃত্যু নয়, এটি একটি যুগের পরিসমাপ্তি। এটি কংগ্রেসের জন্য ধাক্কা এবং বিজেপির উত্থানের জন্য সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির মূল ভিত্তি বদলে যায়—পারিবারিক নেতৃত্বের জায়গায় আদর্শ ও সংগঠনভিত্তিক রাজনীতি সামনে চলে আসে। রাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায়, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন