ভূমিকা
যক্ষ্মা বা টিবি (Tuberculosis) হলো একটি সংক্রামক রোগ যা মানবদেহে প্রধানত ফুসফুসে আক্রমণ করে। যক্ষ্মা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং অনেকেই জীবন হারায়। ২৪শে মার্চ প্রতিটি বছরে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হয়, যার লক্ষ্য হলো যক্ষ্মা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা, রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১. যক্ষ্মা: সংজ্ঞা ও ইতিহাস
১.১ যক্ষ্মা কী?
যক্ষ্মা হলো মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস (Mycobacterium tuberculosis) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ। এটি মূলত ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়, তবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
১.২ যক্ষ্মার ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকেই যক্ষ্মা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মিশরীয় পিরামিডে যক্ষ্মার চিহ্ন পাওয়া গেছে, এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে যক্ষ্মার চিকিৎসার উন্নতি হয়েছে, তবে এটি এখনও বিশ্বব্যাপী একটি বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
২. বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস: গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য
২.১ কেন ২৪শে মার্চ?
২৪শে মার্চ, ১৮8২ সালে ডঃ রবার্ট কোচ মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস আবিষ্কার করেন। এই দিনটিকে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
২.২ দিবসের উদ্দেশ্য
-
যক্ষ্মা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
-
যক্ষ্মা প্রতিরোধে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
-
যক্ষ্মা চিকিৎসায় স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করা।
-
সরকারের নীতি-নির্ধারণে প্রভাব ফেলা।
৩. যক্ষ্মার কারণ ও সংক্রমণ
৩.১ সংক্রমণের পদ্ধতি
যক্ষ্মা মূলত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত কেউ যখন কাশি, ছ্যাঁকা বা কথা বলে, তখন তার ফুসফুস থেকে ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই বাতাস শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে অন্য কেউ সংক্রমিত হতে পারে।
৩.২ যক্ষ্মার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী
-
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা
-
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ
-
যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম (যেমন এইডস রোগীরা)
-
যারা নির্দিষ্ট ওষুধ সঠিকভাবে সেবন করেন না
৪. যক্ষ্মার লক্ষণ ও নির্ণয়
৪.১ যক্ষ্মার লক্ষণ
-
দীর্ঘস্থায়ী কাশি (২ সপ্তাহের বেশি)
-
রক্তস্রাবযুক্ত কাশি
-
ওজন কমে যাওয়া
-
রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
-
জ্বর ও দুর্বলতা
-
শ্বাসকষ্ট
৪.২ যক্ষ্মার নির্ণয়
-
ক্ষতচিত্র বা Chest X-ray
-
মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমে মিউকাস বা ফুসফুস থেকে নমুনা পরীক্ষা (Sputum test)
-
মলিকিউলার টেস্ট (GeneXpert)
-
টিবি স্কিন টেস্ট (Mantoux test)
৫. যক্ষ্মার চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
৫.১ চিকিৎসা পদ্ধতি
যক্ষ্মা চিকিৎসায় নির্দিষ্ট ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা ৬ মাস পর্যন্ত সেবন করতে হতে পারে। চিকিৎসা সঠিকভাবে না করলে প্রতিরোধী যক্ষ্মা (Drug-resistant TB) তৈরি হয়।
৫.২ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
-
ভ্যাকসিনেশন (BCG vaccine)
-
সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়ানো
-
ভাল পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বজায় রাখা
-
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
৬. যক্ষ্মার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনে সামাজিক বঞ্চনা, কাজের স্থানে বাধা, এবং মানসিক চাপ থাকে। এছাড়া, রোগের চিকিৎসায় পরিবার এবং রাষ্ট্রের উপর আর্থিক চাপ তৈরি হয়।
৭. বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা
৭.১ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগ
WHO এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যক্ষ্মা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যেমন:
-
DOTS (Directly Observed Treatment, Short-course)
-
End TB Strategy: ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্য
৭.২ ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। সরকারী উদ্যোগ ও জাতীয় TB প্রোগ্রাম এই রোগ মোকাবিলায় কাজ করছে।
৮. বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে পালনীয় কার্যক্রম
-
জনসচেতনতা ক্যাম্পেইন
-
বিনামূল্যে স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা প্রদান
-
সমাজে যক্ষ্মা আক্রান্তদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা
৯. উপসংহার
যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য রোগ, তবে সঠিক তথ্য, সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসেবা না থাকলে এর প্রকোপ কমানো যায় না। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের গুরুত্ব হলো এই রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সমর্থন দেওয়া ও সবাইকে সচেতন করা।