**ভূমিকা**
অম্বানি পরিবার শুধু ভারতের নয়, গোটা এশিয়ার সবচেয়ে ধনী, ক্ষমতাশালী এবং সম্মানিত ব্যবসায়িক পরিবারগুলির মধ্যে একটি। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুজলাই অম্বানি একটি ছোট্ট ব্যবসা থেকে শুরু করে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, যা আজ টেলিকম, পেট্রোকেমিক্যাল, রিটেল এবং ডিজিটাল ইন্ডাস্ট্রিতে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে। বর্তমানে, তাঁর পুত্র মুকেশ অম্বানি এই সাম্রাজ্যের হাল ধরে রেখেছেন এবং ক্রমাগত নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন।
এই নিবন্ধে আমরা অম্বানি পরিবারের ইতিহাস, তাদের ব্যবসায়িক যাত্রা, সম্পদের উৎস, সামাজিক অবদান, বিতর্ক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।
**ধীরুজলাই অম্বানি: রিলায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বপ্নদ্রষ্টা**
**প্রাথমিক জীবন ও সংগ্রাম**
ধীরুজলাই অম্বানির জন্ম ১৯৩২ সালে গুজরাটের জুনাগড়ে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। আর্থিক সংকটের মধ্যেও ধীরুজলাই পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে ইয়েমেনে একটি কাজের সুযোগ পান। সেখানে তিনি পেট্রোল পাম্পের হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং ব্যবসার প্রাথমিক ধারণা অর্জন করেন।
**রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠা**
১৯৫৮ সালে তিনি মুম্বাইয়ে ফিরে আসেন এবং **রিলায়েন্স কমার্স কর্পোরেশন** নামে একটি ছোট্ট টেক্সটাইল ট্রেডিং কোম্পানি শুরু করেন। তাঁর দূরদর্শিতা এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে রিলায়েন্স দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৬ সালে তিনি **রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (RIL)** প্রতিষ্ঠা করেন এবং পেট্রোকেমিক্যাল, রিফাইনারি ও টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন।
**ধীরুজলাইয়ের ব্যবসায়িক দর্শন**
- **ভারতীয় বাজারে আস্থা**: তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতের বাজার বিশাল সম্ভাবনাময়।
- **উদ্ভাবনী চিন্তা**: তিনি প্রথম ভারতে ইক্যুইটি মার্কেট থেকে তহবিল সংগ্রহ করার পথিকৃৎ ছিলেন।
- **মাস্টার-ব্লাস্টার স্ট্র্যাটেজি**: কম দামে পণ্য বিক্রি করে বাজারে দখল নেওয়া।
**মৃত্যু ও উত্তরাধিকার**
২০০২ সালে ধীরুজলাইয়ের মৃত্যুর পর, তাঁর দুই পুত্র **মুকেশ অম্বানি** ও **অনিল অম্বানি** রিলায়েন্সের দায়িত্ব নেন। তবে পারিবারিক বিরোধের কারণে ২০০৫ সালে কোম্পানিটি ভেঙে দেওয়া হয়।
**মুকেশ অম্বানি: রিলায়েন্সের বর্তমান নেতৃত্ব ও বিশ্বব্যাপী প্রসার**
**ব্যক্তিগত জীবন**
মুকেশ অম্বানির জন্ম ১৯৫৭ সালে। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করতে গিয়েছিলেন, তবে ব্যবসায় যোগ দিতে পড়াশোনা অসমাপ্ত রাখেন। তাঁর স্ত্রী **নীতা অম্বানি** একজন সমাজসেবী এবং মুম্বই ইন্ডিয়ানস আইপিএল দলের মালিক।
**ব্যবসায়িক সাফল্য**
মুকেশ অম্বানির নেতৃত্বে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে:
**১. পেট্রোকেমিক্যাল ও রিফাইনারি**
- **জামনগর রিফাইনারি**: বিশ্বের বৃহত্তম গ্রিনফিল্ড রিফাইনারি, যা দিনে ১.২৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল প্রক্রিয়া করতে পারে।
- **জিও পেট্রোকেমিক্যালস**: প্লাস্টিক, পলিয়েস্টার এবং রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি।
**২. রিলায়েন্স জিও (টেলিকম)**
২০১৬ সালে মুকেশ অম্বানি **জিও** চালু করে ভারতের টেলিকম বাজারে বিপ্লব ঘটান। ৪জি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে ডেটা ও কলিং সুবিধা দেওয়ার ফলে এটি ভারতের সবচেয়ে বড় টেলিকম কোম্পানিতে পরিণত হয়।
**৩. রিলায়েন্স রিটেল**
- **জিওমার্ট**: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম যা কৃষকদের সরাসরি ভোক্তাদের সাথে যুক্ত করে।
- **রিলায়েন্স ফ্রেশ ও ট্রেন্ডস**: সুপারমার্কেট চেইন যা ভারতজুড়ে বিস্তৃত।
**৪. হরাইজন্টাল এক্সপানশন**
- **রিলায়েন্স গ্রিন এনার্জি**: সৌর ও হাইড্রোজেন শক্তিতে বিনিয়োগ।
- **মিডিয়া ও এন্টারটেইনমেন্ট**: নেটফ্লিক্স, ডিজনি+ হটস্টারের সাথে পার্টনারশিপ।
**সম্পদ**
ফোর্বস ২০২৪ অনুযায়ী, মুকেশ অম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণ **$১১০ বিলিয়ন** (৯.১ লক্ষ কোটি টাকা), যা তাঁকে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকায় স্থান দিয়েছে।
**অনিল অম্বানি: পতন ও পুনরুত্থান**
ধীরুজলাইয়ের মৃত্যুর পর, অনিল অম্বানি **রিলায়েন্স কমিউনিকেশন (RCom), রিলায়েন্স পাওয়ার** এবং **রিলায়েন্স ক্যাপিটাল** এর দায়িত্ব নেন। কিন্তু ঋণ সংকট, ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে ভুল এবং প্রতিযোগিতার কারণে তাঁর কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়।
২০২০ সালে, তিনি **ইনসোলvency অ্যান্ড ব্যাংক্রাপ্টসি কোড (IBC)**-এর অধীনে দেউলিয়া ঘোষিত হন। তবে, সম্প্রতি তিনি আবার ব্যবসায় ফিরে এসেছেন এবং গ্রিন এনার্জি খাতে বিনিয়োগ করছেন।
**অম্বানি পরিবারের সামাজিক অবদান**
**১. শিক্ষাখাতে অবদান**
- **ধীরুজলাই অম্বানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল**: মুম্বইয়ের একটি প্রিমিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
- **ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) গান্ধীনগরে অর্থায়ন**।
**২. স্বাস্থ্য খাতে অবদান**
- **কোকিলাবেন ধীরুজলাই অম্বানি হাসপাতাল**: মুম্বইয়ের একটি অত্যাধুনিক মাল্টি-স্পেশালিটি হাসপাতাল।
- **COVID-১৯ মহামারিতে ৫০০ কোটি টাকা দান**।
**৩. ক্রীড়া উন্নয়ন**
- **মুম্বই ইন্ডিয়ানস (MI)**: আইপিএলের সবচেয়ে সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি।
- **ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (ISL)-এ ফুটবল টিমের মালিকানা**।
**বিতর্ক ও সমালোচনা**
**১. রাফায়েল ডিল বিতর্ক**
অনিল অম্বানির কোম্পানি **রিলায়েন্স ডিফেন্স**-এর সাথে রাফায়েল যুদ্ধবিমান চুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
**২. জিও-এর একচেটিয়া আধিপত্য**
জিওর দ্রুত বিস্তারের কারণে অন্যান্য টেলিকম কোম্পানিগুলো (ভোডাফোন আইডিয়া, এয়ারটেল) মার্কেট শেয়ার হারায়, যা নিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন তদন্ত করে।
**৩. পরিবেশগত উদ্বেগ**
জামনগর রিফাইনারি নিয়ে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে।
**ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা**
**১. রিলায়েন্স জিও ৫জি**
২০২৩ সালের মধ্যে সমগ্র ভারতে ৫জি পরিষেবা চালু করার লক্ষ্য রয়েছে।
**২. গ্রিন এনার্জিতে বিনিয়োগ**
২০৩৫ সালের মধ্যে **কার্বন নিউট্রালিটি** অর্জনের লক্ষ্যে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা।
**৩. আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ**
সৌদি আরAM, UAE এবং আফ্রিকার সাথে যৌথ উদ্যোগে পেট্রোকেমিক্যাল ব্যবসা প্রসার।
**উপসংহার**
অম্বানি পরিবারের গল্প শুধু একটি ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্প নয়, এটি একটি স্বপ্ন দেখার এবং তা বাস্তবায়নের গল্প। ধীরুজলাই অম্বানির অদম্য ইচ্ছাশক্তি, মুকেশ অম্বানির কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং পরিবারের সামগ্রিক অবদান ভারতকে বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
তবে, তাদের সমালোচনাও কম নয়। একচেটিয়া আধিপত্য, পরিবেশগত প্রভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, অম্বানি পরিবার ভারতের শিল্প জগতে একটি অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে।
**"সাফল্যের কোন শর্টকাট নেই—কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প এবং দূরদর্শিতা ছাড়া বড় কিছু অর্জন করা যায় না।" — ধীরুজলাই অম্বানি**
📌 **আপনার মতামত জানান:**
- অম্বানি পরিবারের সাফল্য কি আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
- আপনি কি মনে করেন তাদের একচেটিয়া আধিপত্য ভারতের অর্থনীতির জন্য ভালো?