গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদে বেরোলেই অনেকের মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব বা অস্বস্তি দেখা দেয়। এটি সাধারণত ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা), হিট এক্সহশন বা সানস্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে। আজ আমরা আলোচনা করব—রোদে বেরিয়ে মাথা ঘুরলে কী করবেন, কীভাবে প্রতিরোধ করবেন এবং কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
**মাথা ঘোরার সম্ভাব্য কারণ**
**১. ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা)**
রোদে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায়। পর্যাপ্ত পানি না পান করলে রক্তচাপ কমে যায়, মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং মাথা ঘোরা শুরু হয়।
**২. হিট এক্সহশন (তাপীয় অবসাদ)**
দীর্ঘক্ষণ গরমে থাকলে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যাহত হয়। দুর্বলতা, মাথাব্যথা, বমিভাব ও মাথা ঘোরা এর সাধারণ লক্ষণ।
**৩. লো ব্লাড প্রেশার বা শর্করার অভাব**
খালি পেটে রোদে বেরোলেও রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যেতে পারে, ফলে মাথা ঘোরে। আবার কিছু মানুষের লো ব্লাড প্রেশার থাকলে গরমে সমস্যা বাড়ে।
**৪. সানস্ট্রোক (সূর্য্যঘাত)**
এক্সট্রিম কেসে হিট স্ট্রোক বা সানস্ট্রোক হতে পারে, যা জীবন-threatening। এতে শরীরের তাপমাত্রা ১০৪°F-এর বেশি হয়, মাথা ঝিমঝিম করে, বমি হয়, এমনকি জ্ঞানও হারাতে পারেন রোগী।
**রোদে মাথা ঘুরলে তাৎক্ষণিক কী করবেন?**
**১. ছায়ায় বা ঠাণ্ডা জায়গায় যান**
সবচেয়ে প্রথম কাজ হলো রোদ থেকে সরে গিয়ে কোনো ছায়াদার বা শীতল স্থানে বসে পড়ুন। গাছের নিচে, দোকানের ছাউনিতে বা এসি রুমে ঢুকে শরীর ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করুন।
**২. পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন**
ডাবের পানি, ওরাল স্যালাইন বা সাধারণ পানিতে লেবু-চিনি-লবণ মিশিয়ে খান। এতে ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স ফিরবে। কফি বা চা এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো ডিহাইড্রেশন বাড়ায়।
**৩. গায়ের কাপড় ঢিলা করুন**
টাইট জামা-কাপড় শরীরের তাপ বাড়ায়। তাই শার্টের বোতাম খুলে, স্কার্ফ বা হ্যাট খুলে শরীরে বাতাস প্রবেশের সুযোগ দিন।
**৪. পা উঁচু করে শুয়ে পড়ুন**
মাথা ঘোরার সময় চিত হয়ে শুয়ে পা দুটি বালিশ বা উঁচু জায়গায় রাখুন। এতে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়বে এবং ঘোরাভাব কমবে।
**৫. ঠাণ্ডা পানির কমপ্রেস দিন**
মাথা, ঘাড়, হাত-পা ও কপালে ঠাণ্ডা পানির স্পঞ্জ বা ভেজা কাপড় দিন। ফ্যান বা এসির সামনে বসলে দ্রুত শরীরের তাপমাত্রা কমবে।
**৬. হালকা খাবার খান**
যদি বমি না হয়ে থাকে, তাহলে হালকা নোনতা বিস্কুট, ফল (যেমন তরমুজ, শসা) বা ড্রাই ফ্রুটস খেতে পারেন। এগুলো শক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
**৭. বিশ্রাম নিন**
কমপক্ষে ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা বিশ্রাম নিন। হঠাৎ করে দাঁড়াবেন না, এতে আবার মাথা ঘুরতে পারে।
**কখন ডাক্তার দেখাবেন?**
- মাথা ঘোরার সাথে **অজ্ঞান হয়ে যাওয়া**
- **অতিরিক্ত বমি** বা **খিঁচুনি**
- **শ্বাসকষ্ট** বা বুকে ব্যথা
- **জ্বর ১০৩°F-এর বেশি** ও বিভ্রান্তি
- **প্রস্রাব কমে যাওয়া** বা গাঢ় হলুদ হওয়া
এই লক্ষণগুলো হিট স্ট্রোকের ইঙ্গিত দেয়, যা জরুরি হাসপাতালে চিকিৎসা দাবি করে।
**রোদে মাথা ঘোরার সমস্যা প্রতিরোধের উপায়**
**১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন**
রোদে বেরোনোর আগে ও পরে প্রচুর পানি, ডাবের পানি বা ফলের রস পান করুন। প্রতি ১৫-২০ মিনিটে কিছুটা পানি পান করতে হবে।
**২. সানপ্রোটেকশন নিন**
- **ছাতা, হ্যাট বা ক্যাপ** ব্যবহার করুন।
- **সানস্ক্রিন (SPF 30+)** লাগান।
- **সানগ্লাস** ব্যবহার করে চোখকে রোদের হাত থেকে বাঁচান।
**৩. সঠিক সময়ে বের হোন**
সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তীব্র রোদ এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে ছায়াদার রাস্তা বেছে নিন।
**৪. হালকা রঙের সুতি কাপড় পরুন**
গাঢ় রঙের কাপড় তাপ শোষণ করে, তাই সাদা বা হালকা রঙের নরম কাপড় পরুন।
**৫. ভারী কাজ এড়িয়ে চলুন**
রোদে হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি বা ভারী কাজ করবেন না। বারবার ব্রেক নিন।
**৬. স্বাস্থ্যকর খাবার খান**
তাজা ফল, শাকসবজি ও হালকা খাবার রাখুন ডায়েটে। ফাস্ট ফুড বা তেল-মসলাযুক্ত খাবার গরমে এড়িয়ে চলুন।
**৭. বিশেষ সতর্কতা**
ডায়াবেটিস, হার্টের রোগী বা গর্ভবতী নারীরা অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।
**মেডিকেল টিপস**
- **ওআরএস (ORS)** বা নুন-চিনির পানি বাইরে নিয়ে যান।
- **মেন্টল বা তেল** (পিপারমিন্ট) নাকের কাছে ধরলে আরাম পাবেন।
- **প্রোপolis বা গ্লুকোজ ট্যাবলেট** জরুরি সময়ে কাজে লাগে।
**উপসংহার**
রোদে মাথা ঘোরা সাধারণ সমস্যা মনে হলেও এটি গুরুতর হতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন, পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসা নিন। গরমে সুস্থ থাকতে সচেতন হোন, পরিবারের অন্যদেরও সচেতন করুন।
**সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন!**
এই গাইডলাইনটি প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে কাজে লাগবে, তবে কোনো জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।