অজন্তা গুহা কিসের জন্য বিখ্যাত..!!

 


 ভূমিকা 

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা অজন্তা গুহা কমপ্লেক্স বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত এই গুহাগুলো প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলার এক জীবন্ত পাঠশালা। প্রায় ২০০০ বছরের পুরনো এই গুহাগুলি শুধু স্থাপত্য শিল্পেরই নয়, চিত্রকলা, ধর্মীয় ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনেরও এক অসামান্য দলিল। এই বিস্তৃত ব্লগে আমরা অজন্তা গুহার ইতিহাস, স্থাপত্য, চিত্রকলা, ধর্মীয় গুরুত্ব এবং পর্যটন সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করব।


অজন্তা গুহার আবিষ্কার ও ইতিহাস 


 আবিষ্কারের কাহিনী

১৮১৯ সালের এক অদ্ভুত ঘটনায় বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয় অজন্তার গুহার রহস্য। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জন স্মিথ বাঘ শিকারের সময় আকস্মিকভাবে এই গুহাগুলি আবিষ্কার করেন। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় এই গুহাগুলিকে "ঘোড়ার খুরের গুহা" নামে চিনতেন, কারণ গুহার প্রবেশপথ ঘোড়ার খুরের আকৃতির।


ঐতিহাসিক সময়কাল

অজন্তা গুহাগুলি দুটি স্বতন্ত্র সময়কালে নির্মিত হয়েছিল:


১. প্রথম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক):

- সাতবাহন রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত

- হীনযান বৌদ্ধধর্মের প্রভাব

- মূলত চৈত্য গুহা (৯ ও ১০ নং গুহা)


২. দ্বিতীয় পর্যায় (৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতক):

- বিষ্ণুকুণ্ডিন ও চালুক্য রাজবংশের আমলে নির্মিত

- মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসার

- বিহার ও চৈত্য উভয় ধরনের গুহার নির্মাণ


নির্মাণ প্রক্রিয়া

প্রাচীন শিল্পীরা হাতুড়ি, বাটালি ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে কঠিন বেসাল্ট পাথর কেটে এই গুহাগুলি তৈরি করেছিলেন। গুহার দেওয়ালে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে ফ্রেস্কো পদ্ধতিতে চিত্র অঙ্কন করা হতো।


 স্থাপত্য ও গুহার বিন্যাস 


 গুহার শ্রেণীবিভাগ

অজন্তা গুহামালায় মোট ২৯টি গুহা রয়েছে, যা প্রধানত দুই ধরনের:


১. চৈত্য গৃহ (প্রার্থনাকক্ষ):

- গুহা নং ৯, ১০, ১৯, ২৬, ২৯

- স্তূপ কেন্দ্রিক নির্মাণ

- অর্ধবৃত্তাকার ছাদ


২. বিহার (বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল):

- গুহা নং ১, ২, ৪, ৬, ৭, ১১-১৭ ইত্যাদি

- ছোট ছোট কক্ষ

- কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণ


গুরুত্বপূর্ণ গুহাসমূহের বিবরণ


**গুহা নং ১**:

- সবচেয়ে সুসজ্জিত গুহা

- পদ্মপাণি ও বজ্রপাণি বুদ্ধের বিখ্যাত চিত্র

- অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্তম্ভের কাজ


**গুহা নং ২**:

- মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রতীকী চিত্র

- দেবী হরিতি ও পানচিকা মূর্তি

- বিস্তৃত ছাদচিত্র


**গুহা নং ৯ ও ১০**:

- প্রাচীনতম গুহা (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক)

- হীনযান বৌদ্ধ স্থাপত্য

- বুদ্ধের জীবনী সংক্রান্ত চিত্র


**গুহা নং ১৬ ও ১৭**:

- বিষ্ণুকুণ্ডিন রাজবংশ দ্বারা নির্মিত

- "মরণোত্তর বুদ্ধ" চিত্র

- দৈনন্দিন জীবনের চিত্রাবলী


**গুহা নং ১৯, ২৬ ও ২৯**:

- অলংকৃত প্রবেশপথ

- বিশাল স্তূপ

- জটিল খোদাই কাজ


 চিত্রকলা: শিল্পের অনবদ্য নিদর্শন 


শৈল্পিক কৌশল

অজন্তার শিল্পীরা যে পদ্ধতিতে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন তা অত্যন্ত জটিল:


১. প্রস্তুতিমূলক কাজ:

- দেওয়ালে মাটির প্রলেপ

- চুন ও জৈব পদার্থের মিশ্রণ


২. রং তৈরির পদ্ধতি:

- লাল: লাল মাটি ও লাল সীসা

- নীল: ল্যাপিস লাজুলি

- সাদা: চুনাপাথর

- সবুজ: ম্যালাকাইট


৩. অঙ্কন পদ্ধতি:

- ফ্রেস্কো সেকো পদ্ধতি

- ভেজা প্লাস্টারে রং প্রয়োগ

- সূক্ষ্ম ব্রাশের ব্যবহার


 প্রধান চিত্রাবলীর বিবরণ


**বুদ্ধের জীবনী**:

- জন্ম (লুম্বিনী)

- মহাভিনিষ্ক্রমণ

- বোধিজ্ঞান (বোধগয়া)

- ধর্মচক্র প্রবর্তন (সারনাথ)

- মহাপরিনির্বাণ (কুশীনগর)


**জাতক কাহিনী**:

- শিবি জাতক (রাজা শিবির দানশীলতা)

- মহাকাপি জাতক (বানর রাজার আত্মত্যাগ)

- হংস জাতক (সোনালি হাঁসের গল্প)


**সামাজিক চিত্র**:

- রাজদরবারের দৃশ্য

- নর্তকী ও সঙ্গীতজ্ঞ

- ব্যবসা-বাণিজ্য

- কৃষিকাজ


 শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য

১. রেখার সৌন্দর্য:

- প্রবাহমান রেখার ব্যবহার

- অঙ্গভঙ্গির স্পষ্টতা


২. রঙের ব্যবহার:

- প্রাকৃতিক রং

- ছায়া-আলোর খেলা


৩. অভিব্যক্তি:

- মুখাবয়বে বিভিন্ন ভাব

- হাতের ইশারায় অর্থবহন


 ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব 


 বৌদ্ধধর্মের বিকাশে ভূমিকা

অজন্তা গুহা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সাক্ষী:


১. হীনযান বৌদ্ধধর্ম:

- বুদ্ধের প্রতীকী উপস্থাপনা

- স্তূপের প্রাধান্য


২. মহাযান বৌদ্ধধর্ম:

- বুদ্ধের মূর্তি উপাসনা

- বোধিসত্ত্ব ধারণা


৩. তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম:

- মন্ত্র ও যন্ত্রের ব্যবহার

- দেব-দেবীর উপস্থাপনা


 সাংস্কৃতিক সমন্বয়

অজন্তার শিল্পে দেখা যায় বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশেল:

- স্থানীয় আদিবাসী শৈলী

- গান্ধার শিল্পের প্রভাব

- গুপ্ত সাম্রাজ্যের শিল্পরীতি


 সংরক্ষণ ও পর্যটন


সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ

১. প্রাকৃতিক ক্ষতি:

- আর্দ্রতা

- শৈত্য প্রবাহ

- শৈবালের বৃদ্ধি


২. মানবসৃষ্ট ক্ষতি:

- পর্যটকের স্পর্শ

- ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফি

- ভ্যান্ডালিজম


 সংরক্ষণ পদক্ষেপ

১. ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের উদ্যোগ:

- বিশেষজ্ঞ টিম গঠন

- আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার


২. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা:

- ইউনেস্কোর সহায়তা

- জাপানের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ


 পর্যটন তথ্য

১. ভ্রমণের সেরা সময়:

- অক্টোবর থেকে মার্চ

- গ্রীষ্মে এড়িয়ে চলুন


২. প্রবেশ নিয়ম:

- সময়: সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা

- সাপ্তাহিক বন্ধ: সোমবার

- টিকিট মূল্য: ভারতীয় ৪০ টাকা, বিদেশি ৬০০ টাকা


৩. ভ্রমণ পরামর্শ:

- গাইড নিয়োগ

- পর্যাপ্ত পানি বহন

- ফ্ল্যাশ ব্যবহার নিষিদ্ধ


উপসংহার 

অজন্তা গুহা শুধু পাথরে খোদাই কিছু গুহার সমষ্টি নয়, এটি মানবসভ্যতার এক মহামূল্যবান সম্পদ। এই গুহাগুলি আমাদেরকে প্রাচীন ভারতের শিল্পী, স্থপতি ও দার্শনিকদের অসামান্য মেধার সাক্ষ্য দেয়। অজন্তার দেওয়ালে আঁকা চিত্রগুলি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস গ্রন্থ, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস ও শিল্পবোধ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এই অনন্য সাংস্কৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। অজন্তা গুহার মতো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলি আমাদের শিখায় যে শিল্প ও সংস্কৃতি কখনই মর্যাদাহীন হয় না, বরং তা কালের সাক্ষী হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন