[শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু]
**ভূমিকা**
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হলেন ভক্তিযোগ ও কীর্তন-ভজনের মহান প্রবর্তক। তিনি ১৫শ শতাব্দীতে বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয়ে প্রেরণা জোগায়।
**জন্ম ও শৈশব**
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম **১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি-মার্চ)** নবদ্বীপে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা) হয়েছিল। তাঁর পিতার নাম **জগন্নাথ মিশ্র** এবং মাতার নাম **শচীদেবী**। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল **বিশ্বম্ভর**, কিন্তু স্নেহে সবাই তাঁকে **নিমাই** বা **গৌরাঙ্গ** বলতেন।
[নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য জন্মভূমি]
শৈশব থেকেই নিমাই অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
**শিক্ষা ও যৌবন**
নিমাই নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন এবং খুব অল্প বয়সেই **নিমাই পণ্ডিত** নামে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তর্কে অপরাজেয় ছিলেন এবং শীঘ্রই নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃতি পান।
যৌবনে তিনি **লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী**কে বিবাহ করেন, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয়। পরে তিনি **বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী**কে বিবাহ করেন।
**ধর্মীয় পরিবর্তন ও সন্ন্যাস**
নিমাই পণ্ডিতের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে যখন তিনি **গয়া** তীর্থে যান এবং তাঁর গুরু **ঈশ্বর পুরী**-এর সান্নিধ্যে আসেন। সেখানে তিনি কৃষ্ণনামের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেন এবং ভক্তিতে নিমগ্ন হন।
নবদ্বীপে ফিরে আসার পর, তিনি **কীর্তন আন্দোলন** শুরু করেন। হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয়ে ভক্তির সঞ্চার করেন। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে, তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং নাম গ্রহণ করেন **শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু**।
**পুরী যাত্রা ও ভক্তিবাদের প্রচার**
সন্ন্যাস গ্রহণের পর, শ্রীচৈতন্য পুরী (ওড়িশা) যান এবং সেখানে **জগন্নাথ মন্দিরে** কৃষ্ণভক্তির প্রচার শুরু করেন। তিনি সারা ভারত ভ্রমণ করেন এবং বহু ভক্ত ও পণ্ডিতদের আকর্ষণ করেন। তাঁর প্রধান শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন—
1. **নিত্যানন্দ প্রভু**
2. **অদ্বৈত আচার্য**
3. **শ্রীবাস পণ্ডিত**
4. **গদাধর পণ্ডিত**
5. **হরিদাস ঠাকুর**
তিনি **শিক্ষা দিতেন**:
- **হরিনাম সংকীর্তন** (সামূহিক কৃষ্ণনাম জপ) হল পরম ধর্ম।
- **ভগবদ্গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত** হল শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ।
- **সকল জীবই ঈশ্বরের অংশ**, তাই সবাইকে সম্মান করতে হবে।
**শেষ জীবন ও disappearence (তিরোধান)**
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শেষ বছরগুলি পুরীতে কাটে। তিনি ভক্তদের মধ্যে **প্রেমভক্তি** (ঈশ্বরের প্রতি প্রেমময় ভক্তি) ছড়িয়ে দেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র ৪৭ বছর বয়সে, তিনি **জগন্নাথ মন্দিরে** অদৃশ্য হন (তিরোধান)।
[পুরীর জগন্নাথ মন্দির]
**শ্রীচৈতন্যের শিক্ষা ও প্রভাব**
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা আজও বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক। তাঁর প্রধান বাণীগুলি হল:
1. **"হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।"**
2. **"জীবে দয়া, নামে রুচি।"** (প্রাণীতে দয়া ও ঈশ্বরের নামে অনুরাগ)
3. **"অহৈতুকী কৃষ্ণভক্তি"** (কোনো শর্ত ছাড়াই কৃষ্ণভক্তি)
তাঁর প্রতিষ্ঠিত **গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়** আজও বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণভক্তির প্রচার করে চলেছে, বিশেষত **ইসকন (ISKCON)**-এর মাধ্যমে।
**উপসংহার**
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শুধু একজন ধর্মগুরু নন, তিনি ছিলেন **প্রেম ও ভক্তির মূর্ত প্রতীক**। তাঁর জীবন ও শিক্ষা মানুষকে আধ্যাত্মিকতা ও মানবতার পথ দেখায়। আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভক্তিপথে এগিয়ে চলেছেন।
**"প্রেমে ভক্তিযোগে চৈতন্য, জগৎ করে আলো!"**